চোদ্দশাকা ব্রত কি?
কালী পূজোর আগের দিন অর্থাৎ ভূত চতুর্দশীতে বাঙালির চোদ্দটি শাকের মিশ্রণ রান্না করে খাওয়ার যে প্রথা প্রচলিত আছে তা চোদ্দশাকা ব্রত নামে পরিচিত।
চোদ্দশাকা ব্রত পালনের প্রাসঙ্গিকতা:
'ফাস্টফুড'-এ অভ্যস্ত বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ভাতের সঙ্গে শাক খাওয়া ব্যাপারটা ভুলতে বসেছে। ভোজের পাত থেকেও শাক পদটি প্রায় বিদায় নিয়েছে। তবুও কালী পুজোর আগের দিন অর্থাৎ ভূত চতুর্দশীতে বাঙালির চৌদ্দটি শাকের মিশ্রণ রান্না করে খাওয়ার প্রথা প্রচলিত আছে।
বেশিরভাগ মানুষই এ সম্পর্কে জানেন না বা জানার চেষ্টাও করেন না, কেউ বা এটাকে নিছক কুসংস্কার বলেই মনে করেন। তবে ঐদিন বাজারে গেলে দেখা যায় কেউ কেউ চৌদ্দ রকমের শাকপাতার পসরা নিয়ে বসে আছেন।
গ্রামের মানুষজন চৌদ্দ রকমের শাকপাতা মাঠ-ঘাট থেকেই জোগাড় করেন। পুরাণে এর উল্লেখ না থাকলেও মনে করা হয় ঋকবেদের বাস্কল বা শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণগণই এই শাক চতুর্দশী প্রবর্তন করেন। লোক পরম্পরায় আজও তা চলে আসছে।
অবশ্য এর পিছনে বৈজ্ঞানিক যুক্তিও আছে। একটি প্রবাদ আছে চৌদ্দ শাক খেলে নাকি 'কার্তিকের টান' থেকে অব্যহতি পাওয়া যায়, কারণ এই সময় যমরাজের আটটি দরজা খোলা থাকে। আমরা কমবেশী সকলেই জানি বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে।
আরোও পড়ুন: ব্রহ্মকমল কি?
বাংলায় ঋতু গুলি খুবই প্রকট। বর্ষাকালে জলবাহিত রোগের প্রকোপ বেশি থাকে। তাছাড়া, বর্ষাকালে হজম শক্তিও কমে যায়। বর্ষা থেকে ভুগতে থাকা মানুষজনের অনেকেই কার্তিক মাসে আবহাওয়া পরিবর্তনের ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে মৃত্যু বরণ করেন। তাই 'কার্তিকের টান' কথাটি প্রচলিত আছে।
বর্ষার পরে দৈহিক সুস্থতা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য চৌদ্দ রকম শাক খেয়ে শরীরে প্রাকৃতিক ভ্যাকসিন প্রয়োগ করার প্রথা আজও চলে আসছে।
ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার বিখ্যাত পন্ডিত স্মার্ত রঘুনন্দন 'কৃত্যতত্ত্ব' গ্রন্থে চৌদ্দটি শাকের কথা উল্লেখ করেন। এদের কোনটির সমগ্র অংশ কোনটির বা পাতা শাক হিসাবে ব্যবহৃত হয়। তবে প্রতিটিই ঔষধি গুণ সম্পন্ন। শাক গুলি হলো —
(১) ওল (Amorphophallus campanulatus) -অর্শ রোগের বড় ঔষধ
(২) কেঁউ(Costus speciosus) - কৃমি প্রতিহত করে,
(৩) বেতো(Chenopodium album) - লিভারের কার্যকারিতা সঠিক রাখে,
(৪) কালকাসুন্দা (Cassia occidentalis) - কাস মর্দিত করে,
(৫) সরষে (Brassica campestris) - মলমূত্রের সারল্য আনে।
(৬) নিম (Azadiracta indica) - পিত্তজ চর্মরোগকে বিনষ্ট করে।
(৭) জয়ন্তী (Sesbania sesban) - ঋতু পরিবর্তন জনিত সর্দি থেকে রক্ষা করে।
(৮) শালিঞ্চ (Alternanthera sessilis) - জীবাণুনাশক, জ্বররোধী ও মধুমেয় প্রতিরোধী।
(৯) গুড়ুচী বা গুলঞ্চ(Tinospora cordifolia) - বায়ু বিকার দূর করে।
(১০) পলতা বা পটল পাতা(Trichosanthes dioica) - সঞ্চিত পিত্তদোষকে বিনষ্ট করে।
(১১) শেলূকা(Cordia dichotoma) - ক্ষুধাবর্দ্ধক ও রুচিকারক
(১২) হিঞ্চে(Enhydra fluctuans) - কফ্ ও পিত্তদোষ দূর করে
(১৩) ঘেঁটুপাতা(Clerodendrum infortunatum) - কৃমি প্রতিহত করে এবং
(১৪) শুশনি(Marsilea quadrifolia) - স্নায়ুতন্ত্রকে নিস্তেজ করে ঘুম পাড়ায়।
এই শাকের সবগুলি অনেকের কাছে সহজলভ্য না হওয়ায় বা না চেনার কারণে নটে, সজনে, পুঁই, কলমি, পালং, লাউ, কুমড়ো ইত্যাদি চৌদ্দ রকমের পাতা মিশিয়েও রান্না করা হয়। তবে এতেও উপকার আছে।
আয়ুর্বেদশাস্ত্রে শাক শব্দটির অর্থ ব্যাপক। শাকপাতা ছাড়াও পুষ্প, ফল, ভূনিম্নস্থ কান্ড, মূল এমনকি মাশরুমকেও শাক হিসাবে গণ্য করা হয়।
এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে পাতা শাকে অধিক পরিমাণে সেলুলোজ (এক প্রকার শর্করা) থাকে। কিন্তু আমাদের পাচকরসে সেলুলেজ এনজাইম না থাকায় তা পরিপাক (হজম) হয় না। তবে সেলুলোজ রাফেজ সৃষ্টির মাধ্যমে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে ফিসার, পাইলস্, কোলন ক্যানসার প্রভৃতি দূরারোগ্য ব্যাধি রোধ করে। সেইজন্য বর্ষাকাল বাদ দিয়ে সারা বছরই অল্প অল্প করে শাকপাতা খাওয়া প্রয়োজন।
বাংলায় ঋতুভেদে ব্রত পালনের মাধ্যমেও বিভিন্ন প্রকারের শাক খাওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। এর পিছনেও একই কারণ– রোগমুক্তি ও শরীরকে সুস্থ রাখা। ভূত চতুর্দশী বা কৃষ্ণ চতুর্দশীর দিনটি হলো শাক খাওয়ার সূচনা। সুতরাং 'চৌদ্দ শাকা' কোন কুসংস্কার নয়, শুধু ধর্মীয় ব্রত পালন নয়, রোগমুক্তির এক অনন্য উপায়।
আধুনিক গবেষণায় জানা গিয়েছে কেঁউ শাকটি গ্রামে-গঞ্জে লাল হলুদ নামে পরিচিত। ঔষধি হিসাবে চিরাচরিত ব্যবহার ছাড়াও এটি ডায়াবেটিস মেলিটাস (মধুমেহ) রোগেরও মহৌষধ। তাই একে বলা হচ্ছে 'ইনসুলিন উদ্ভিদ'।
এটি এখন বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ হওয়ার ব্যাপক হারে চাষ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আবার শুশনি শাকে মার্সিলিন উপক্ষার থাকায় স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত করে ঘুমাতে সাহায্য করে। বর্তমানে অনেক চিকিৎসকও ঠিক মতো ঘুম না হওয়া রোগীকে 'সিডেটিভ ড্রাগ'-এর পরিবর্তে শুশনি শাক খাওয়ার পরামর্শ দেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not enter any spam link in the comment box.