মাত্র এক মাসের ব্যবধান, এরই মধ্যে স্কুল সার্ভিস কমিশন (SSC)-এর চতুর্থ শ্রেণির পর এবার তৃতীয় শ্রেণির কর্মী নিয়োগেও বিরাট বেনিয়ম হয়েছে বলে কলকাতা হাই কোর্ট (Calcutta High Court)-এ রিপোর্ট পেশ করে জানাল অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিত কুমার বাগের অনুসন্ধান কমিটি। একই সঙ্গে বাগ কমিটি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশে গঠিত উপদেষ্টা কমিটিকেও বেআইনি বলে জানিয়েছে ।
SSC নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত ৩৩ টি আপিল মামলার শুনানি ছিল গত শুক্রবার। আদালতের নির্দেশে এদিন তৃতীয় শ্রেণির কর্মী নিয়ে দুর্নীতির রিপোর্ট পেশ করে বাগ কমিটি, তাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হিসাবে মোট ১১ জন SSC কর্তার নাম সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ জনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রুজু অর্থাৎ এফআইআর (FIR) দায়ের করে তদন্ত শুরু করতে এবং ৬ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছে।
এদিন ডিভিশন বেঞ্চে গ্রুপ সি (Group-C) নিয়োগের দুর্নীতি নিয়ে বাগ কমিটির আইনজীবী অরুণাভ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, প্যানেলের মেয়াদ শেষের পরেও বেআইনিভাবে মোট ৩৮১ জনকে নিয়োগ করা হয়েছে। তার মধ্যে ২২২ জনের নাম কোনও প্যানেল বা ওয়েটিং লিস্টে ছিল না। এরা পার্সোনালিটি টেস্টে অংশগ্রহণ করেনি, তাই ধরে নেওয়া যেতেই পারে এরা কেউ লিখিত পরীক্ষায় পাস করেনি বা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি। বাকি ১৫৯ জনের ক্ষেত্রে নম্বর বাড়িয়ে এবং ওএমআর (OMR) শিটে গন্ডগোল করে ওয়েটিং লিস্টের পিছনের থেকে সামনে এনে নিয়োগ করা হয়েছে।
এর আগেও গত ১১ এপ্রিল SSC-র চতুর্থ শ্রেণির কর্মী নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে বলেই আদালতে রিপোর্ট পেশ করে জানিয়েছিল হাই কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচার-পতি রঞ্জিত কুমার বাগের অনুসন্ধান কমিটি। সেক্ষেত্রে ৬০৯ জনের নিয়োগ সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে হয়েছিল বলে জানিয়েছিল বাগ কমিটি। মেধাতালিকা বা চূড়ান্ত মেধা-তালিকা, কোনও ক্ষেত্রে তাঁদের নাম ছিল না।
এদিনও নিয়োগ দুর্নীতির রিপোর্ট পেশ করে সল্টলেকের
আনন্দলোক হাসপাতালের কাছে নতুন ভবন থেকে এই নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বাগ কমিটি।এছাড়াও ডিভিশন বেঞ্চে পেশ করা রিপোর্টে বাগ কমিটি উল্লেখ করেছে, দুর্নীতির ভূমিকায় এসএসসির উপদেষ্টা
কমিটির প্রাক্তন আহ্বায়ক শান্তিপ্ৰসাদ সিনহা, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়, স্কুল সার্ভিস
কমিশনের চেয়ারম্যান সৌমিত্র সরকার, স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্রোগ্রামিং অফিসার সমরজিৎ আচার্য এবং স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের সচিব অশোক কুমার সাহা – এই পাঁচ জনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র,জালিয়াতি, প্রতারণা- সহ ভারতীয় দণ্ডবিধির ফৌজদারি আইনের একাধিক ধারায় মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করা যেতে পারে।
এছাড়াও এসএসসি প্রাক্তন চেয়ারম্যান শর্মিলা মিত্র, সুবিরেশ ভট্টাচার্য এবং কমিশনের আঞ্চলিক চেয়ারম্যান এসএসসি-র শুভজিৎ চট্টোপাধ্যায়, শেখ সিরাজউদ্দিন, মহুয়া বিশ্বাস, চৈতালি ভট্টাচার্য— এই ছয়জনের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বিভাগীয় পদক্ষেপ করা উচিত। সেই সঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অনুমোদনের ভিত্তিতে যে উপদেষ্টা কমিটি হয়েছিল, তা বেআইনি বলে দাবি করা হয়েছে রিপোর্টে।
বাগ কমিটি জানিয়েছে, প্যানেলের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরে শূন্যপদের তথ্য নিয়ে বেআইনিভাবে সেই তথ্য কাজে
লাগিয়েছেন শান্তিপ্রসাদ সিনহা এবং সৌমিত্র সরকার।সবটা বেছে স্থির করা হত সুপারিশ কমিটির তরফে।সুপারিশ পত্র ছাপানোর কাজ করেছিলেন সমরজিৎ আচার্য। এর পর কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে ভুয়া সুপারিশ পত্র পাঠানো হত। আর সেই সুপারিশের ভিত্তিতে টেকনিক্যাল অফিসার রাজেশ লায়েককে দিয়ে কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় ভুয়ো নিয়োগপত্র তৈরি করতেন। সিডি, পেনড্রাইভ, এমনকী, ই-মেলের মাধ্যমেও এই সুপারিশ পত্র আসত।
এদিন তৃতীয় শ্রেণির চাকরিপ্রার্থী সাবিনা ইয়াসমিন, যার মামলার প্রেক্ষিতেই সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন
বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য, সুদীপ্ত দাশগুপ্তরা জানান, “স্কুল সার্ভিস কমিশনের গোটা নিয়োগ পদ্ধতিটাই দুর্নীতিগ্রস্ত। এটা বিচ্ছিন্ন নয়। এর আগে সিঙ্গল বেঞ্চেও বিষয়টি সামনে এসেছিল। এবার বাগ কমিটির রিপোর্টেও বিস্তারিতভাবে বলা আছে কারা কারা যুক্ত এর সঙ্গে। একেবারে শীর্ষস্থানীয় তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর নামও এসে গিয়েছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের আদালতের কাছে দাবি, যে এটার ফৌজদারি তদন্ত হোক। আর সেটা রাজ্যসরকারের পুলিশের পক্ষে করা সঙ্গত হবে না। সেই সাহসিকতা নেই যে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তথ্য দেবে। এটা একমাত্র সিবিআই করতে পারে।"
রাজ্যের তরফে অ্যাডভোকেট জেনারেল সৌমেন্দ্রনাথ
মুখোপাধ্যায় জানান, “পুলিশ এই মামলার তদন্ত করতেই পারে। একক বেঞ্চ পুলিশের উপর আস্থা রাখছে। আবার
সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। এমনটা তো হয়নি যে পুলিশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তারা পারেনি। বিভাগীয় বা ক্রিমিনাল হোক পুলিশ এই তদন্ত করতেই পারে।” তবে যেহেতু এই মামলায় আগেই তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল সিঙ্গল বেঞ্চ, পরে সেই নির্দেশে অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দেয় ডিভিশন বেঞ্চ, তাই এই মামলার অন্যতম পক্ষ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের হয়ে আইন-জীবী অনিন্দ্য মিত্র জানান, তাঁর মক্কেলের বক্তব্য না শুনেই, তাঁর বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল সিঙ্গল বেঞ্চ। এই মামলায় তার বক্তব্য শোনা হোক।
এসএসসি নিয়ে কুণাল ঘোষ বলেন, “যদি কোথাও কোনও
ভুল থাকে সেটা তদন্ত কমিটি যখন কোর্টে রিপোর্ট দিচ্ছেন সেখানে নিশ্চিতভাবে আলোচিত হবে। আমার মনে হয়, এটা প্রশাসনিক বিষয়। এটা রাজ্য সরকারের তরফ থেকেই যাঁরা বলার তাঁরা ঠিকঠাকভাবে বলতে পারবেন।”
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikari) প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতার দাবি করেন। SSC-র প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্য জানান, তাঁরা স্বচ্ছভাবেই কাজ করেছেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not enter any spam link in the comment box.