মহা শিবরাত্রি হল একটি গৌরবময় অনুষ্ঠান যার অন্তর্নিহিত মনোযোগ, উপবাস, শিবের (Lord Shiva) উপর ধ্যান স্ব-অধ্যয়ন, সামাজিক সম্প্রীতি এবং শিব মন্দিরে সারা রাত্রি জাগরণ করার জন্য উল্লেখযোগ্য।
উদযাপনের মধ্যে সারা রাত জাগরণ এবং প্রার্থনা বজায় রাখা অন্তর্ভুক্ত, কারণ শৈব হিন্দুরা এই রাতটিকে শিবের মাধ্যমে নিজের জীবনে এবং জগতে অন্ধকার এবং অম্লতা-কে জয় করা হিসাবে চিহ্নিত করে। শিবের উদ্দেশ্যে ফল-পাতা, মিষ্টি এবং দুধের নৈবেদ্য দেওয়া হয়,কেউ কেউ শিবের বৈদিক বা তান্ত্রিক উপাসনার সাথে সারাদিন উপবাস করেন এবং কেউ কেউ ধ্যানমূলক যোগ করেন শিব মন্দিরে শিবের পবিত্র পঞ্চাক্ষরী মন্ত্র ওঁ নমঃ শিবায় জপ করা হয়। শিব চালিসা পাঠের মাধ্যমে ভক্তরা শিবের স্তব করেন।
মহা শিবরাত্রি হিন্দু লুনি-সৌর ক্যালেন্ডারের উপর ভিত্তি করে তিন বা দশ দিন ধরে পালিত হয়। প্রতি চান্দ্র মাসে একটি শিবরাত্রি হয় (প্রতি বছর ১০টি) প্রধান উৎসবকে বলা হয় মহা মহান শিবরাত্রি, যা ১৩ তম রাতে (অন্তমিত চাঁদ) এবং ফাল্গুন মাসের ১৪ তম দিনে অনুষ্ঠিত হয়। গ্রেগরীয় বর্ষ-পঞ্জিতে দিনটি ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসে পড়ে।
বেশ কয়েকটি পুরাণে মহাশিবরাত্রির উল্লেখ রয়েছে। বিশেষ করে স্কন্দপুরাণ, লিঙ্গপুরাণ এবং পদ্মপুরাণে। এই মধ্যযুগীয় শৈব গ্রন্থগুলিতে উপবাস ও লিঙ্গরূপে শিবের পুজার কথা উল্লেখ রয়েছে। বিভিন্ন কিংবদন্তি মহা শিবরাত্রির তাৎপর্য বর্ণনা করে।
একটি কিংবদন্তি অনুসারে, এই রাতে শিব সৃষ্টি, সংরক্ষণ এবং ধ্বংসের স্বর্গীয় নৃত্য(তাণ্ডব) করেন। স্তোত্রের জপ শিব ধর্মগ্রন্থ পাঠ এবং ভক্তদের ঐকতান সংগীত এই মহা-জাগতিক নৃত্যে যোগ দেয় এবং সর্বত্র শিবের উপস্থিতি স্মরণ করে।
আরেকটি কিংবদি অনুসারে, রাতেই শিব ও পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল। এর নিগুঢ় অর্থ হল শিব ও শক্তি তথা পুরুষ ও আদিশক্তি বা পরাপ্রকৃতির মিলন।
একটি ভিন্ন কিংবদন্তিতে বলা হয়েছে যে লিঙ্গের মতো শিব মূর্তিগুলিকে অর্পণ করা হল একটি বার্ষিক উপলক্ষ যা অতীতের পাপ থেকে মুক্তি পেতে একটি পুণ্য পথে পুনরায় শুরু করার এবং ফলে কৈলাশ পর্বতে পৌঁছানো এবং মুক্তি লাভ। এই উৎসবের নৃত্য ঐতিহ্যের তাৎপর্য ঐতিহাসিক শিকড় রয়েছে। মহা শিবরাত্রি কোনার্ক, খাজুরাহো, পাটদা-কাল, মোধেরা এবং চিদাম্বরমের মতো প্রধান হিন্দু মন্দির-গুলিতে বার্ষিক নৃত্য উৎসবের জন্য শিল্পীদের একটি ঐতিহাসিক মিলন হিসাবে কাজ করেছে।
চিদাম্বরম মন্দিরে অনুষ্ঠানটিকে নাট্যাঞ্জলি বলা হয়।আক্ষরিক অর্থে নৃত্যের মাধ্যমে উপাসনা, যা তার ভাস্কর্যের জন্য বিখ্যাত নাট্যশাস্ত্র নামক পরিবেশনের শিল্পকরার প্রাচীন হিন্দু পাঠে সমস্ত নৃত্য মুদ্রাকে চিত্রিত করে। একইভাবে আলেকজান্ডার কানিংহামের ১৮৯৪ সালে নথি অনুসারে খাজুরাহোর শিব মন্দিরগুলিতে মহা শিবরাত্রিতে একটি প্রধান মেলা এবং নৃত্য উৎসব করত, যেখানে শৈব তীর্থযাত্রী-রা মন্দির চত্বরের চারপাশে মাইল জুড়ে ক্যাম্প করেছিলেন।
বছরের শুরুতেই হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব পালিত হবে আগামী ৮ মার্চ। ভোলেবাবাকে খুশি করতে মহাশিবরাত্রির দিন চার প্রহরের পূজো ও ব্রত পালন করেন শিবভক্তরা। সনাতন ধর্মে, মহাশিবরাত্রি উপবাসকে মহাদেবকে উপাসনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়।
বৈদিক ক্যালেন্ডার অনুসারে, এবছর মহাশিবরাত্রি উপবাস ব্রত ৮ মার্চ, শুক্রবার পালন করা হবে। এই বিশেষ ও শুদ্ধ দিনে শিবঠাকুরের আরাধনা করলে জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধির বন্যা শুরু হয় বলে মনে করা হয়। এছাড়াও অনেক ধরনের গ্রহ দোষও দূর হয়। শাস্ত্রে বলা হয়েছে মহাশিবরাত্রির দিনে শুভ সময়ে ভগবান শিবের আরাধনা করলে সব ধরনের মনস্কামনা পূর্ণ হয়। যারা চার প্রহরের উপবাস ও ব্রত পালন করে শিবলিঙ্গে জল ঢালেন, তাদের জন্য মহাশিবরাত্রি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি যারা প্রহর গুণে নয় এদিনের যেকোনও সময়েই শিবপুজো ও শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢালেন, তাদের জন্যও অভ্যন্ত গুরুত্বের। কারণ, এদিন জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধির কারণে 'বিশেষ কিছু যোগ তৈরি হতে চলেছে।
মহাশিবরাত্রির শুভ মুহুর্ত
বৈদিক ক্যালেন্ডার অনুসারে, ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথি শুরু হবে ৮ মার্চ রাত ১টা ৫৭ মিনিট থেকে। শেষ হবে ৯ মার্চ সন্ধ্যে ৬টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত। মহাশিবরাত্রির দিন, নিশিতা কালে নিয়ম মেনে মহাদেবের পূজো করা হয়ে থাকে। আর তাই সেই উপবাস পালিত হবে ৮ মার্চ, শুক্রবার। এদিন নিশিতা কাল পূজার শুভ মুহূর্ত পড়েছে দুপুর ১২টা ৭ মিনিট থেকে রাত ১২টা ৫৫ মিনিটের মধ্যে।
মহাশিবরাত্রির চারপ্রহরের সময়
শাস্ত্রে বলা হয়েছে, মহাশিবরাত্রির দিন সাধারণত চার প্রহরে শিবের আরাধনা সম্পন্ন হয়। মহা-শিবরাত্রির দিন প্রথম প্রহরের উপবাস ও পুজো শুরু হবে সন্ধ্যে ৬টা ২৫ মিনিটে, দ্বিতীয় প্রহরের পূজো ও উপবাস শুরু হবে রাত সাড়ে ৯টায়।এরপর তৃতীয় প্রহরের পুজো শুরু হবে রাত ১২টা ৩১ মিনিটে এবং শেষ ও চতুর্থ প্রহরের পূজা শুরু হবে ভোর ৩টা ৩৪ মিনিটে। মহাশিবরাত্রির ব্রত ও উপবাস সমাপ্ত হবে ভোর ৬টা ৩৫ মিনিটে। পঞ্চাঙ্গ অনুসারে, ৯ মার্চ সকাল ৬টা ৩৭ মিনিট থেকে দুপুর সাড়ে ৩টার মধ্যে মহাশিবরাত্রির উপবাস ভাঙতে পারেন শিবভক্তরা।
মহাশিবরাত্রির শুভ যোগ
পঞ্চাঙ্গ মতে, মহাশিবরাত্রির দিনে শিব ও সিদ্ধ যোগ গঠিত হচ্ছে। শিবযোগ চলবে মধ্যরাত ১২টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত। তারপরে শুরু হবে সিদ্ধ যোগ। যেখানে মহাশিবরাত্রি উপবাস শ্রাবণ নক্ষত্রে পালন করা হবে, যা চলবে সকাল ১০ টা ৪১ মিনিট পর্যন্ত। এই পবিত্র ও বিশেষ দিনে সর্বার্থ সিদ্ধি যোগও গঠিত হচ্ছে। মহাশিবরাত্রির দিনে সর্বার্থ সিদ্ধি যোগ চলবে সকাল ৬টা ৩৮ মিনিট থেকে ১০টা ৪১ মিনিট পর্যন্ত।
মহাশিবরাত্রির দিন মহাদেব ও পার্বতীর আরাধনা করারও পরীতি রয়েছে। বৈদিক ধর্মীয় গ্রন্থ অনুসারে এদিনে মহাদেব ও পার্বতী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, এই বিশেষ দিনে শিব-পাবতীর আরাধনা করলে সমস্ত সিদ্ধিলাভ হয়। কেটে যায় জীবনের সমস্ত সমস্যা। পাশাপাশি এদিনে শুদ্ধচিত্তে পূজো ও উপবাস রাখলে দাম্পত্য জীবনেও সুখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not enter any spam link in the comment box.